ঢাকা ০১:১২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্যাংক ঋণের সুদহার কমানো যায়নি, উল্টো বেড়ে চলছে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৪২:১৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০১৯
  • ২৩১ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বড় বাধা মনে করা হয়। বেশি সুদে টাকা নিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন বলে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এ কারণে সুদহার কমাতে ব্যাংকগুলোকে একের পর এক সুবিধা দিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকের মুনাফার ওপর কর কমানো হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাধ্যতামূলক নগদ জমা রাখার (সিআরআর) হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি আমানত বাড়ানো হয়েছে। এসব সুবিধা দিয়েও সুদহার কমানো যায়নি, উল্টো বেড়েছে। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে একের পর এক দাবি নিয়ে সরকারের কাছে যান ব্যাংকের উদ্যোক্তারা।

আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তারা প্রতিশ্রুতি দেন, দাবি মানা হলে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কে নামিয়ে আনবেন। গত বছর ২০ জুন এক বৈঠক শেষে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি পরবর্তী ১ জুলাই থেকে এক অঙ্ক সুদে ঋণ বিতরণ করা হবে বলে ঘোষণা দেয়। এজন্য সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ দেয় সরকার। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার ‘রেপো’ সুদহার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে নামানো হয়। এর আগের বছর করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করে সরকার। এসব সুবিধা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল, ব্যাংকগুলো এক অঙ্ক সুদে ঋণ বিতরণ করবে। এ ছাড়া ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে গত বছর এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক এবং একজন পরিচালক টানা নয় বছর থাকার সুযোগ দিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়।

সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার কার্যকরের জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকে চিঠি দিয়ে ঘোষণার আলোকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ এবং ৬ শতাংশ সুদে আমানত কার্যকরের পরামর্শ দেয়। এর পরও ঋণের সুদহার না কমে বরং বাড়ছে। গত মঙ্গলবার একনেক বৈঠকে সুদহার নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

জানা গেছে, সিঙ্গেল ডিজিটে সুদহার কার্যকরের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অর্থমন্ত্রীকে আবারও সব পক্ষের সঙ্গে বসতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্পের মেয়াদি ঋণে সুদ নিয়েছে ১২ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ। দুটি ব্যাংক ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদে এসএমই ঋণ দিয়েছে। ২০১৮ সালে ব্যাংকের উদ্যোক্তারা যখন সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন, ব্যাংকগুলো এসএমইর মেয়াদি ঋণ বিতরণ করে ১১ থেকে ১৫ শতাংশ সুদে। এর আগে ২০১৭ সালের জুনে ৯ থেকে ১৩ শতাংশ সুদ ছিল।

একইভাবে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত বড় শিল্পের মেয়াদি ঋণে সুদের হার ১০ শতাংশের কম ছিল। ২০১৮ সালে যা ১২ থেকে ১৩ শতাংশের ওপরে ওঠে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ১৩ থেকে ১৭ শতাংশে উঠেছে। বাড়ি-গাড়ি কেনার ঋণে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ সুদ নিচ্ছে ব্যাংক। ক্রেডিট কার্ডে অধিকাংশ ব্যাংকের সুদহার রয়েছে ১৮ থেকে ২৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সুদহার কমাতে চাইলে সবার আগে খেলাপি ঋণ কমানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য শুধু পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন না করে খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হতে হবে। এক খাতের নামে দেওয়া ঋণ যেন আরেক খাতে ব্যবহার না হয়, সেখানে তদারকি বাড়াতে হবে।

এভাবে ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত তারল্য এলে আমানতের সুদহার না কমিয়েও ঋণের সুদহার কমানো সম্ভব। এ জন্য সরকারকে কোনো সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এ ছাড়া সাজসজ্জায় ব্যয় কমানো এবং উচ্চ মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া থেকে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের বিরত থাকতে হবে। তাহলে সুদহার কমবে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, সুদহার নিম্নমুখী ধারায় রাখতে ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতে সুদহারের সর্বোচ্চ ব্যবধান ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশনা রয়েছে। আবার উচ্চ সাজসজ্জায় ব্যয় কমানোর মাধ্যমে খরচ কমাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ঋণের সুদহারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ঠেকাতে বছরে ১ শতাংশের বেশি সুদ না বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্য যে কোনো ঋণের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ বেশি সুদ নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। যদিও বেশিরভাগ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা মানছে না।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমানতের সুদ না কমলে ঋণের সুদ কমানো দুরূহ ব্যাপার। এর আগে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সুদহার কমানোর জন্য সরকারকে কোনো সুবিধা দিতে হয়নি। এমনিতেই তখন সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছিল। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমানত পরিস্থিতির উন্নতি হলে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামবে বলে তার আশা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ব্যাংক ঋণের সুদহার কমানো যায়নি, উল্টো বেড়ে চলছে

আপডেট টাইম : ০৯:৪২:১৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বড় বাধা মনে করা হয়। বেশি সুদে টাকা নিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন বলে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এ কারণে সুদহার কমাতে ব্যাংকগুলোকে একের পর এক সুবিধা দিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকের মুনাফার ওপর কর কমানো হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাধ্যতামূলক নগদ জমা রাখার (সিআরআর) হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি আমানত বাড়ানো হয়েছে। এসব সুবিধা দিয়েও সুদহার কমানো যায়নি, উল্টো বেড়েছে। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে একের পর এক দাবি নিয়ে সরকারের কাছে যান ব্যাংকের উদ্যোক্তারা।

আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তারা প্রতিশ্রুতি দেন, দাবি মানা হলে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কে নামিয়ে আনবেন। গত বছর ২০ জুন এক বৈঠক শেষে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি পরবর্তী ১ জুলাই থেকে এক অঙ্ক সুদে ঋণ বিতরণ করা হবে বলে ঘোষণা দেয়। এজন্য সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ দেয় সরকার। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার ‘রেপো’ সুদহার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে নামানো হয়। এর আগের বছর করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করে সরকার। এসব সুবিধা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল, ব্যাংকগুলো এক অঙ্ক সুদে ঋণ বিতরণ করবে। এ ছাড়া ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে গত বছর এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক এবং একজন পরিচালক টানা নয় বছর থাকার সুযোগ দিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়।

সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার কার্যকরের জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকে চিঠি দিয়ে ঘোষণার আলোকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ এবং ৬ শতাংশ সুদে আমানত কার্যকরের পরামর্শ দেয়। এর পরও ঋণের সুদহার না কমে বরং বাড়ছে। গত মঙ্গলবার একনেক বৈঠকে সুদহার নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

জানা গেছে, সিঙ্গেল ডিজিটে সুদহার কার্যকরের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অর্থমন্ত্রীকে আবারও সব পক্ষের সঙ্গে বসতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্পের মেয়াদি ঋণে সুদ নিয়েছে ১২ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ। দুটি ব্যাংক ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদে এসএমই ঋণ দিয়েছে। ২০১৮ সালে ব্যাংকের উদ্যোক্তারা যখন সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন, ব্যাংকগুলো এসএমইর মেয়াদি ঋণ বিতরণ করে ১১ থেকে ১৫ শতাংশ সুদে। এর আগে ২০১৭ সালের জুনে ৯ থেকে ১৩ শতাংশ সুদ ছিল।

একইভাবে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত বড় শিল্পের মেয়াদি ঋণে সুদের হার ১০ শতাংশের কম ছিল। ২০১৮ সালে যা ১২ থেকে ১৩ শতাংশের ওপরে ওঠে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ১৩ থেকে ১৭ শতাংশে উঠেছে। বাড়ি-গাড়ি কেনার ঋণে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ সুদ নিচ্ছে ব্যাংক। ক্রেডিট কার্ডে অধিকাংশ ব্যাংকের সুদহার রয়েছে ১৮ থেকে ২৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সুদহার কমাতে চাইলে সবার আগে খেলাপি ঋণ কমানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য শুধু পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন না করে খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হতে হবে। এক খাতের নামে দেওয়া ঋণ যেন আরেক খাতে ব্যবহার না হয়, সেখানে তদারকি বাড়াতে হবে।

এভাবে ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত তারল্য এলে আমানতের সুদহার না কমিয়েও ঋণের সুদহার কমানো সম্ভব। এ জন্য সরকারকে কোনো সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এ ছাড়া সাজসজ্জায় ব্যয় কমানো এবং উচ্চ মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া থেকে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের বিরত থাকতে হবে। তাহলে সুদহার কমবে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, সুদহার নিম্নমুখী ধারায় রাখতে ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতে সুদহারের সর্বোচ্চ ব্যবধান ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশনা রয়েছে। আবার উচ্চ সাজসজ্জায় ব্যয় কমানোর মাধ্যমে খরচ কমাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ঋণের সুদহারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ঠেকাতে বছরে ১ শতাংশের বেশি সুদ না বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্য যে কোনো ঋণের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ বেশি সুদ নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। যদিও বেশিরভাগ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা মানছে না।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমানতের সুদ না কমলে ঋণের সুদ কমানো দুরূহ ব্যাপার। এর আগে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সুদহার কমানোর জন্য সরকারকে কোনো সুবিধা দিতে হয়নি। এমনিতেই তখন সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছিল। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমানত পরিস্থিতির উন্নতি হলে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামবে বলে তার আশা।